মেনোপজ সময়ে আত্মহত্যার প্রবণতা!: গবেষণায় আশার আলো হরমোন থেরাপি!
মেনোপজ, বাঙলায় যাকে বলে রজঃনিবৃত্তি, অর্থাৎ নারীদের একটি বয়সের পর পুরোপুরি মাসিক ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া। পৃথিবীর সকল নারীর জীবনে একটি বয়সে এসে এটি ঘটে কিন্তু বাংলাদেশে শব্দটি নিয়ে খুব একটা প্রকাশ্যে আলোচনা হতে দেখা যায় না। মেনোপজ নারীর শরীরে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে। সময়মতো সঠিক যত্ন না নিলে অনেক স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে নারীরা মেনোপজের প্রভাব নিয়ে কথা বলেন না, এর জন্য কোন প্রস্তুতি নেন না এবং নীরবে মানিয়ে নেন।
মেনোপজ নিয়ে নারীর ভাবনা!
ঢাকার একটি আবাসিক এলাকায় ফ্ল্যাটের দরজা খুলে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন ঘরের গৃহকর্ত্রী। বসতে বলে চায়ের জোগাড় করতে গেলেন। মেনোপজের মতো একটি বিষয় নিয়ে কথা বলতে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছিলেন। দুই ছেলে মেয়ে চারপাশে আছে কিনা একটু নজর বুলিয়ে নিলেন। দুই ছেলেমেয়ে যার যার ঘরে গান শুনছে দেখে একটু আশ্বস্ত হলেন। কিন্তু আসল কথায় এলে মেনোপজ সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা দিতে পারলেন না ৪৫ বছর বয়সী এই নারী। তিনি জানালেন, “না আমি আসলে কোন প্রস্তুতি নেই নাই বা এরকম কিছু সম্পর্কে আসলে খুব একটা জানিও না”। কেউ কি কখনো বিষয়টি বিষয়টা সম্পর্কে তথ্য দিয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “হ্যাঁ আমি শুনছি মাসিকটা বন্ধ হয়ে যায়। তখন কিছু শারীরিক সমস্যা হয়। আমাদের বড় বোন ও ভাবিদের কাছে শুনেছি”।
বিশ্বব্যাপী সকল নারীর একটি বয়সের বাস্তবতা হচ্ছে মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত ব্রিটিশ মেডিকেল বুলেটিন বলছে, বয়স অনুপাতে গড়ে একজন নারীর জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় মেনোপজের মধ্য দিয়ে কাটে। যার একদম প্রাথমিক লক্ষণ খুব গরম লাগা।
সেই অনুভূতিকে গুরুত্ব দেননি এমন একজন বলছিলেন, “আমার মাঝে মাঝে হঠাৎ যখন খুব গরম লাগতো, একদম মনে হত যে শরীর জলে যাচ্ছে, ভাবতাম কিরে এত গরম লাগে কেন? এরকম হচ্ছে কেন? আবার হঠাৎ মেজাজ খুব খিটখিট লাগতো। বুঝতাম না প্রথমে, পাত্তাও দেই নাই।” গরম ও খিটখিটে মেজাজের চেয়েও অনেক বেশি প্রভাবিত হয়েছে এই নারীর শরীর। অস্টিওপোরোসিসের কারণে তার মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে গেছে। হাড় ক্ষয়ে যাওয়ার কিছু লক্ষণ আগেই বুঝেছিলেন কিন্তু মেনোপজের পর তা বেশ জটিল আকার ধারণ করে।
তিনি বলছেন, “আমার বয়স এখন ৫৫। আমার মাসিক বন্ধ হইছে ৫০ বছরের দিকে। ফ্যামিলিতে মেয়ে মানুষ যারা ছিল তারা সবাই আমার চেয়ে বয়সে ছোট। কারোর সাথে যে কথা বলবো সেটাও পারি নাই”।
শারীরিক পরিবর্তনের সময় হিসেবে মেনোপজ বা পেরিমেনোপজ (যে সময়ে ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়া শুরু হয়) আমাদের সকলের কাছে পরিচিত। কিন্তু এ সময় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যে কী ধরনের গুরুতর প্রভাব পড়তে পারে, তা প্রায়শই আলোচনা করা হয় না। সম্প্রতি “The mental health challenges, especially suicidality, experienced by women during perimenopause and menopause: A qualitative study” শিরোনামে যুক্তরাজ্য (UK) ভিত্তিক প্রকাশিত একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধে এই বিষয়ে উদ্বেগজনক কিছু তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল পেরিমেনোপজ এবং মেনোপজের সময় নারীরা মানসিক স্বাস্থ্যগত যেসব সমস্যার সম্মুখীন হন, বিশেষ করে আত্মহত্যার প্রবণতা কতটুকু, তা গভীরভাবে বোঝা এবং স্বাস্থ্যসেবার ভূমিকা বিশ্লেষণ করা।
৪২ জন নারীর ওপর পরিচালিত এই গুণগত গবেষণায় দেখা গেছে- অংশগ্রহণকারীরা হতাশা, একাকীত্ব ও বাঁচার আগ্রহ হারিয়ে ফেলার মতো মানসিক কষ্টের কথা জানিয়েছেন। এদের মধ্যে মৃদু ভাবনা থেকে শুরু করে আত্মহত্যার চেষ্টা পর্যন্ত বিভিন্ন মাত্রার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। অনেকেই যথাযথ চিকিৎসা পেতে দেরি করেছেন। হরমোনের সমস্যার কারণে মানসিক কষ্ট হলেও, তাদের ভুল করে কেবল বিষণ্ণতা বা দুশ্চিন্তা কমানোর ঔষধ (Antidepressants) দেওয়া হয়েছে, যা উপসর্গগুলোকে আরও খারাপ করেছে। নারীরা জানিয়েছেন, এই সময়ে তারা এক ধরণের ‘হতাশা ও ফাঁদে আটকে থাকার’ অনুভূতিতে ভোগেন।
এছাড়াও বাংলাদেশের ঢাকা শহর কেন্দ্রিক “The prevalence and associated factors of depression during pre-, peri-, and post-menopausal period among the middle-aged women of Dhaka city” শীর্ষক এই গবেষণায় দেখা গেছে, মেনোপজ ট্রানজিশনের সময় (পেরিমেনোপজ, মেনোপজ পরবর্তী সময়ে) মহিলাদের মধ্যে বিষণ্ণতা (Depression) এবং উদ্বেগ (Anxiety)-এর সমস্যা বেশ প্রকট। ঢাকা শহরের মধ্যবয়সী ৩২৬ জন মহিলা অংশগ্রহণকারীদের উপর করা একটি গবেষণায় প্রায় ৩০.৪% মহিলার মধ্যে মেজর ডিপ্রেশন পাওয়া গেছে।
আশার আলো হরমোন থেরাপি
গবেষণায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে, তা হলো: যারা সময়মতো ও সঠিকভাবে হরমোন প্রতিস্থাপন থেরাপি (HRT) পেয়েছেন, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। HRT-তে ডাক্তার রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী ইস্ট্রোজেন এবং প্রয়োজনে প্রজেস্টেরন হরমোন ট্যাবলেট, জেল বা প্যাচ আকারে দেন, যাতে মেনোপজজনিত উপসর্গগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং নারীর জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। সঠিক চিকিৎসা পেলে এই গুরুতর মানসিক সমস্যাগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
গবেষকদের মতে, স্বাস্থ্যকর্মীদের আরও ভালো প্রশিক্ষণ দেওয়া, দ্রুত HRT-এর ব্যবস্থা করা এবং সমন্বিত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এই সমস্যা মোকাবিলায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মেনোপজের সময় নারীর মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিলে বহু জীবন বাঁচানো সম্ভব।
উৎস : মেনোপজ: নারীত্ব, যৌনতা, আবেগ, শারীরিক জটিলতা, রজঃনিবৃত্তির প্রভাব নিয়ে যত প্রশ্ন, বিবিসি বাংলা।
